ঢাকা সকাল ৮:২৬ সোমবার, ১৩ই অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
আজকের সর্বশেষ সবখবর

মহাদুর্ভোগের নাম বিআরটি প্রকল্প:
চালু হলে ২৫ জেলার যাত্রী সরু মহাসড়কে ভোগান্তিতে পড়বে

নিজস্ব প্রতিবেদক
জুলাই ৮, ২০২৪ ৫:২৪ অপরাহ্ণ
Link Copied!

একটি প্রকল্প বাস্তবায়নকালে জনদুর্ভোগ কতটা ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে, তার বড় দৃষ্টান্ত বিমানবন্দর থেকে জয়দেবপুর পর্যন্ত বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্প।
২০১৮ সালে প্রকল্পের কাজ শুরুর পর থেকে প্রায় ছয় বছর ধরে এ প্রকল্পের কারণে এই সড়কে সীমাহীন দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে লাখো মানুষ। বিমানবন্দর-জয়দেবপুর সড়কে উত্তরা, টঙ্গী ও গাজীপুরের মানুষের পাশাপাশি প্রতিদিন আরও বহু জেলার মানুষ চলাচল করে; রাজধানী থেকে বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের সব জেলায় যাওয়ার এটিই মূল সড়ক।
বিমানবন্দর থেকে জয়দেবপুর পর্যন্ত এই করিডরটি বিআরটি প্রকল্পের জন্য উপযুক্ত কি না, এ প্রশ্নও দেখা দিয়েছে। অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, এ ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়নের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে আরও গবেষণার দরকার ছিল।
অনেকে এও মনে করেন, ভুল জায়গায় ভুল নকশায় ভুলভাবে বিআরটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এ প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও পদে পদে ভুল দৃষ্টান্ত তৈরি হয়েছে। চলতি বছরের ডিসেম্বরে প্রকল্পের কাজ শেষ করার লক্ষ্য পুনঃনির্ধারণ করা হলেও নতুন করে মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। এসব কারণে এ প্রকল্প থেকে জনগণ কাঙ্ক্ষিত সুফল পাবে কি না, তা অনিশ্চিত।
বিআরটি প্রকল্প চালু হলে দুর্ভোগ আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। টঙ্গী থেকে গাজীপুর পর্যন্ত সড়কের ফুটপাতের প্রশস্ততা এমনিতেই কম। তার ওপর স্টেশনের পিলার, সিঁড়ির কারণে বন্ধ হয়ে গেছে পুরো ফুটপাত। এটিকে প্রকল্পের বড় ভুল বলছেন পরিবহন বিশেষজ্ঞরা। ফলে বিআরটি প্রকল্প চালু হলে দুপাশের রাস্তা প্রশস্ত কম হওয়ায় উত্তর বঙ্গে চলাচলকারী যানবাহন বিশেষ করে ময়মনসিংহ, শেরপুর, নেত্রকোণা, জামালপুর, কিশোরগঞ্জ, টাঙ্গাইল এবং গাজীপুরের বিভিন্ন উপজেলা থেকে ঢাকা চলাচলের গাড়িগুলো ভয়াবহ যানজটে পড়বে। এছাড়াও ফুটপাত বন্ধ করে স্টেশনের স্থাপনা নির্মাণ, বিশেষ লেনের দুই পাশে বিভাজক না রাখা, ফুটপাত প্রশস্ত না থাকা এবং সড়কের পাশের পোশাক কারখানার শ্রমিকদের চলাচলের সুযোগ না থাকায় প্রকল্পের সামগ্রিক সুফল নিয়ে অনেকে শঙ্কা প্রকাশ করছেন। যানজট, ভোগান্তির পাশাপাশি দুর্ঘটনার ঝুঁকিও থেকে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিআরটি করিডোরে বাস চালু হলে তার সুফল শুধু ঢাকা-গাজীপুর রুটের যাত্রীরা ভোগ করবে। কিন্তু ঢাকার প্রান্তে সংযুক্ত ২৫ জেলার যাত্রী সরু মহাসড়কে ভোগান্তিতে পড়বে।
এদিকে রাজধানীর বিমানবন্দর থেকে গাজীপুরের জয়দেবপুর পর্যন্ত সাড়ে ২০ কিলোমিটার সড়কে সাত বছর ধরে চলছে বাস র‍্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পের কাজ। দফায় দফায় সময় ও ব্যয় বাড়ানো প্রকল্পটি চলতি বছরের আগামী অক্টোবর মাসে খুলে দেওয়া হতে পারে।
ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে গাজীপুরের চান্দনা চৌরাস্তা পথে চলাচলকারীদের দুর্ভোগ লাঘবে নেওয়া এই প্রকল্পের কাজ শেষ হলে মাত্র ৪০ মিনিটে বাসে করে গাজীপুর থেকে বিমানবন্দর যাতায়াত করা যাবে বলে জানালেন প্রকল্পের কর্মকর্তারা। বিআরটির পূর্বশর্তই হলো যাত্রী বা পথচারীদের চলাচলে আবেদন সৃষ্টিকারী চওড়া ফুটপাত। এখানে উল্টো ফুটপাত বন্ধ করে স্টেশন করা হয়েছে। এর মাধ্যমে সমস্যা আরও বেড়ে গেল।
জানতে চাইলে গাজীপুরের ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) সিভিল অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রধান হোসাইন মো. শাহিন গণমাধ্যমকে বলেন, বিআরটি অংশ বাদ দিলে এই সড়কে একটি করে লেন। একটি লেন দিয়ে যানবাহন স্বাভাবিক গতিতে চলতে পারবে না। প্রকল্পের সবচেয়ে বড় ভুল পোশাক কারখানার শ্রমিকদের কথা ভাবা হয়নি। তাঁরা কিন্তু বিআরটি বাসে উঠবেন না। তাঁদের হাঁটার জায়গাও বন্ধ হচ্ছে। এই প্রকল্প নিয়ে মন্তব্য করতে বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই, সাধারণ মানুষও বুঝতে পারবে এর ভবিষ্যৎ খারাপ। তবে বিআরটি প্রকল্পের পরিচালক ইলিয়াস শাহ বলেন, প্রকল্পটি নিয়ে অনেকেই অনেক কিছু বলতে বা শঙ্কা প্রকাশ করতে পারেন। তবে প্রকল্প চালু হলে বলা যাবে, কী ধরনের সমস্যা হচ্ছে। সেই অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া যাবে। তিনি বরেন ইতিমধ্যে ফুটপাত প্রশস্তকরণ কাজ শুরু হয়েছে।
বিআরটির জন্য বিশেষ লেনের দুই পাশে নেই সড়ক বিভাজক। স্টেশনগুলো বিআরটি লেনের ওপর। উচ্চতা প্রায় ৬ মিটার। স্টেশনের দুই পাশের পিলার ফুটপাতের ওপর। স্টেশনে ওঠানামার জন্য চারটি চলন্ত ও পায়ে হাঁটার দুটি সিঁড়ি রাখা হয়েছে। সব কটি ফুটপাতের ওপর। এ জন্য স্টেশন এলাকায় ফুটপাত বন্ধ হয়ে গেছে। এসব জায়গা পার হতে পথচারীদের মূল সড়কে নামতে হচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১২ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০১৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত চার বছর মেয়াদ ছিল প্রকল্পটির। কিন্তু কাজ শুরু হয় ২০১৭ সালে। পরে তিন দফা প্রকল্প সংশোধন করে এ বছরের আগস্ট মাস পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানো হয়। পরে আবারও সময় বাড়িয়ে অক্টোবর পর্যন্ত করা হযেছে। যদিও এ সময়ের মধ্যে কাজ শেষ হবে কিনা তা নিশ্চিত বলা যাচ্ছে না।
প্রকল্পের শুরুতে ব্যয় ধরা হয়েছিল ২ হাজার ৩৯৮ কোটি ৪ লাখ টাকা। তিন দফা সংশোধনের পর ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ২৬৮ কোটি ৩২ লাখ ৪৩ হাজার টাকা। শুরুতে প্রকল্পের দৈর্ঘ্য ছিল চান্দনা চৌরাস্তা থেকে ঢাকার কেরানীগঞ্জ পর্যন্ত। পরে সময় ও ব্যয় বাড়ানো হলেও প্রকল্পটি সংকুচিত করে চান্দনা চৌরাস্তা থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত করা হয়। প্রকল্পটি যৌথভাবে বাস্তবায়ন করছে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) ও বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ (বিবিএ)।
প্রকল্পে এলিভেটেড (উড়াল অংশ) থাকছে ৮ দশমিক ৫ কিলোমিটার। স্টেশন ২৫টি। এর মধ্যে ঢাকায় ৪টি ও গাজীপুর মহানগরীতে পড়েছে ২১টি। উড়ালসড়ক থাকছে ৯টি, প্রতিটি স্টেশনেই থাকবে পদচারী–সেতুর ব্যবস্থা। প্রকল্পের ২০ দশমিক ৫ কিলোমিটার সড়ক উন্নয়নে সওজের কাজ ১৬ কিলোমিটার, যার মধ্যে ৯টি উড়ালসড়ক। উড়ালসড়কের কাজ শেষ হয়েছে। এলজিইডির আওতাধীন দুটি প্যাকেজের অগ্রগতি শতভাগ। প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি ৯০ শতাংশ। ৯টি উড়ালসড়কের কোনোটির একটি লেন আবার কোনোটির দুই দিকের লেন খুলে দেওয়া হয়েছে। ২৫টি স্টেশনের মধ্যে একটির কাজও শেষ হয়নি। সড়ক পারাপারে প্রতিটি স্টেশনে পদচারী সেতু নির্মাণের কথা থাকলেও মাত্র একটির কাজ শেষ হয়েছে। বিআরটির জন্য বিশেষ লেনের দুই পাশে নেই সড়ক বিভাজক। স্টেশনগুলো বিআরটি লেনের ওপর। উচ্চতা প্রায় ৬ মিটার। স্টেশনের দুই পাশের পিলার ফুটপাতের ওপর। স্টেশনে ওঠানামার জন্য চারটি চলন্ত ও পায়ে হাঁটার দুটি সিঁড়ি রাখা হয়েছে। সব কটি ফুটপাতের ওপর। এ জন্য স্টেশন এলাকায় ফুটপাত বন্ধ হয়ে গেছে। এসব জায়গা পার হতে পথচারীদের মূল সড়কে নামতে হচ্ছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিআরটির মাঠপর্যায়ের একজন প্রকৌশলী বলেন, ‘ফুটপাতের প্রশস্ততা এমনিতেই কম। তা ছাড়া জায়গায় জায়গায় স্টেশনের পিলার ও সিঁড়ি বসায় এটি কোনো কাজে আসবে না। মানুষজনকে ঘুরেফিরে রাস্তায় হাঁটতে হবে। প্রকল্পের শুরুতে যেভাবে নকশা করা হয়েছে বা ঊর্ধ্বতন স্যাররা যেভাবে নির্দেশনা দিচ্ছেন, আমাদের সেভাবেই কাজ করতে হচ্ছে।’
সড়কে ক্রমেই যানবাহন বাড়ছে। বিআরটি স্টেশন এলাকাগুলোতে সড়ক কিছুটা চেপে যাওয়ায় যান চলাচলে ধীরগতি দেখা দিচ্ছে। এর মধ্যে মানুষ ফুটপাত ব্যবহার করতে না পারলে ব্যাপক যানজট দেখা দেবে। মালেকের বাড়ি এলাকার ব্যবসায়ী শাহজাহান সরকার বলেন, গাজীপুরে অনেক কলকারখানা আছে। প্রতিদিন ফুটপাত দিয়ে হাজার হাজার শ্রমিক চলাচল করেন। সড়ক চালুর আগে ফুটপাত তৈরিতে জোর দিতে হবে। গাজীপুরের সাংবাদিক বশির আহমেদ বলেন, বিআরটির বাস চলার জন্য মাঝে আলাদা লেন করা হয়েছে। সাধারণ যানবাহন চলাচলে দুই পাশে যে জায়গা রাখা হয়েছে, তা খুবই কম। অনেক জায়গায় ফুটপাতও নেই।
বিআরটি স্টেশনের স্থাপনার কারণে ওই এলাকার সড়ক কিছুটা সরু হয়ে গেছে। তিন লেনের রাস্তা কমে প্রায় দুই লেনে দাঁড়িয়েছে। এতে একসঙ্গে অনেক যানবাহন চলতে গিয়ে স্টেশন এলাকায় যান চলাচলে ধীরগতি দেখা দিচ্ছে। পাশাপাশি পথচারীরা সড়ক ধরে হাঁটায় মাঝেমধ্যে যানজট দেখা দিচ্ছে। মহানগর পুলিশ ও পরিবহন–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সড়কটি শুধু উত্তরা, টঙ্গী ও গাজীপুরের মানুষই ব্যবহার করে না; বৃহত্তর ময়মনসিংহের সব জেলার মানুষের মূল পথ এটি। ঢাকার সঙ্গে কিশোরগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, এমনকি বৃহত্তর সিলেটের সড়ক যোগাযোগেরও বিকল্প পথ এটি। উত্তরবঙ্গগামী যানবাহনের একটা বড় অংশ চলে উত্তরা-আবদুল্লাহপুর হয়ে। এ জন্য সড়কটি যানজটমুক্ত রাখা জরুরি।
সরেজমিনে দেখা যায়, ব্যস্ত সড়কে প্রচুর গাড়ি চলাচল করছে। এর মধ্যে দুপুরের খাওয়ার বিরতিতে সড়কে বের হয়েছেন বিভিন্ন পোশাক কারখানার হাজারো শ্রমিক। ফুটপাত না থাকায় ঝুঁকি নিয়ে তাঁরা যানবাহনের মধ্যে সড়কের পাশ দিয়ে হাঁটছেন।
কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর গাজীপুর শাখা কার্যালয়ের তথ্যমতে, গাজীপুর মহানগরে নিবন্ধিত পোশাক কারখানা আছে ৪৯২টি। এর বাইরে ছোট বড় কয়েক শত কারখানা আছে। এসব কারখানার অধিকাংশই ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক সংলগ্ন। প্রতিদিন সকালে কারখানায় যাওয়ার সময়, দুপুরে খাওয়ার বিরতি ও সন্ধ্যায় কারখানা ছুটির পর সড়কে হাজারো শ্রমিকের ঢল নামে।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের সভাপতি কল্পনা আক্তার বলেন, শ্রমিকেরা সবাই পায়ে হাঁটা মানুষ। তাঁদের চলাচলে প্রশস্ত ফুটপাত খুবই জরুরি। কিন্তু এ সড়কে তা বাস্তবায়ন করা হয়নি। বিআরটি প্রকল্পেও এর বাস্তবায়ন দেখা যায়নি। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক সামছুল হক গণমাধ্যমকে বলেন, বিআরটির পূর্বশর্তই হলো যাত্রী বা পথচারীদের চলাচলে আবেদন সৃষ্টিকারী চওড়া ফুটপাত। এখানে উল্টো ফুটপাত বন্ধ করে স্টেশন করা হয়েছে। এর মাধ্যমে সমস্যা আরও বেড়ে গেল। হাজার হাজার মানুষকে ঝুঁকিতে ফেলে দেওয়া হলো। প্রকল্প কর্তৃপক্ষ এ দায় এড়াতে পারে না।

বিনা অনুমতিতে এই সাইটের সংবাদ, আলোকচিত্র অডিও ও ভিডিও ব্যবহার করা বেআইনি।