ঢাকা রাত ৮:০৪ রবিবার, ১২ই অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
আজকের সর্বশেষ সবখবর

রেমালে লণ্ডভণ্ড সুন্দরবন

রাশিদুল ইসলাম, খুলনা
মে ২৯, ২০২৪ ১২:৪৭ পূর্বাহ্ণ
Link Copied!

ঘূর্ণিঝড় রেমালের তাণ্ডব ও জলোচ্ছ্বাসে সুন্দরবনে অর্ধশতাধিক হরিণ মারা গেছে। সুন্দরবন উপকূলে নদীতে ভাসছে অসংখ্য মৃত হরিণ। তবে মঙ্গলবার বিকাল পর্যন্ত সুন্দরবনে কটকার জামতলায় থেকেই ৩৯টি হরিণের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, সুন্দরবনে বন্যপ্রাণীর মৃতের সংখ্যা আরও ছাড়িয়ে যাবে। এ ছাড়া একটি শূকরসহ অসংখ্য পশুপাখি মৃত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। ১৭টি হরিণ উদ্ধার করে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে বনে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। দুদিনের ঝড়ে সুন্দরবনে প্রায় ৬ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বনবিভাগ সূত্রে জানা গেছে। তবে সুন্দরবনে প্রতিনিয়ত ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বাড়ছে। খুলনা মৎস্য বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ঘূর্ণিঝড় রেমালের তাণ্ডবে জলোচ্ছ্বাস এবং জোয়ারের পানিতে বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয়েছে লোকালয়। সেইসঙ্গে ভেসে গেছে ৩ হাজার ৬০০ পুকুর এবং ৯ হাজার ১১৫টি ঘেরের মাছ, চিংড়ি, কাঁকড়া, পোনা।এতে ক্ষতি হয়েছে ২৪৫ কোটি ৯৫ লাখ ৫০ হাজার টাকার মৎস্য সম্পদের।
এ ছাড়া ঝড়ে আহত ১৩টি হরিণ উদ্ধার করে বনে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। দুটি হরিণের অবস্থা আশঙ্কাজনক। জলোচ্ছ্বাসের কারণে সুন্দরবনের মিষ্টি পানির আঁধার শতাধিক পুুকুর লবণাক্ত পানিতে প্লাবিত হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে উপকূলের ৩ জেলায় ৬১ কিলোমিটার বাঁধ পুরোপুরি এবং কিছু এলাকায় আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ঝড়ে অসংখ্য ঘেরের চিংড়ি ও পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। শত শত গ্রামে চিংড়ির ঘেরসহ ফসলি জমিতে নোনা পানি প্রবেশ করে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে বলে জানা গেছে।
সুন্দরবন বনবিভাগ সূত্র জানায়, দীর্ঘ ৩৬ ঘণ্টা ধরে সুন্দরবনের ওপর দিয়ে ঘূর্ণিঝড় রেমাল তাণ্ডব চালিয়েছে। এসময় ৭০-৮০ কিলোমিটার গতির ঝড়ো বাতাস ও দমকা হাওয়ায় বনের বহু জায়গার গাছপালা ভেঙে গেছে। বনবিভাগের বিভিন্ন স্টেশনের কাঠের জেটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ছাড়া, ঘূর্ণিঝড়ের সময় ১০ থেকে ১২ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসের কারণে সুন্দরবনের অভ্যন্তরের মিষ্টি পানির আধার শতাধিক পুকুর লবণাক্ত পানিতে প্লাবিত হয়েছে। এতে খাবার পানির সংকট দেখা দিয়েছে।
সূত্র জানায়, ঝড়ের পর প্রাথমিকভাবে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করা সম্ভব না হলেও ধারণা করা হচ্ছে, ঝড়ের সময় জলোচ্ছ্বাসের কারণে গাছপালার চেয়ে সুন্দরবনের বন্যপ্রাণীর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। কারণ দীর্ঘ ৩৬ ঘণ্টাব্যাপী সুন্দরবন ১০ থেকে ১২ ফুট জোয়ারের পানিতে নিমজ্জিত ছিল। এসময় সুন্দরবনের নদ-নদীতে ঘূর্ণি বাতাসের সঙ্গে প্রচণ্ড ঢেউ ছিল। ফলে হরিণসহ সুন্দরবনের বন্যপ্রাণির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বনবিভাগ সূত্র জানায়, ঝড়ের পর মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত একটি মৃত হরিণ উদ্ধার করা হয়েছে। এ ছাড়াও বনকর্মীরা বেশকিছু হরিণ নদীতে ভেসে যেতে দেখেছে। কিন্তু ওই সময় নদী উত্তাল থাকার কারণে হরিণগুলো উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। তবে বিভিন্ন ক্যাম্প সংলগ্ন জায়গা থেকে ঝড়ে আহত ১৭টি হরিণ উদ্ধার করার পর চিকিৎসা সেবা করে সুন্দরবনে ছেড়ে দেয়া হয়েছে।
সুন্দরবন পশ্চিম বনবিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ড. আবু নাসের মহসিন হোসেন জানান, ঝড়ে ২ কোটি ৬১ লাখ টাকার সম্পদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বনে মিষ্টি পানির পুকুড় সব তলিয়ে গেছে। ফলে সুপেয় পানির ব্যাপক সংকট দেখা দেবে। বনবিভাগের অফিস ও আবাসনের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ৮টি হরিণ উদ্ধার করে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে।
জানতে চাইলে সুন্দরবন পূর্ব বনবিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা কাজী মুহম্মদ নুরুল কবির জানান, ঝড়ে পূর্ব বিভাগে ৩ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এ ছাড়া ৫টি আহত হরিণ উদ্ধার করে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে।
এ ব্যাপারে সুন্দরবনের বন সংরক্ষক (সিএফ) মিহির কুমার দে বলেন, প্রলয়ঙ্কারী ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত শুধুমাত্র কটকার জামতলায় ৩৯টি মৃত হরিণ উদ্ধার করা হয়েছে। তবে ধারণা করা হচ্ছে, সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। ওই এলাকা থেকে একটি শূকরের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এ ছাড়াও বনকর্মীরা বেশকিছু হরিণ নদীতে ভেসে যেতে দেখেছে। এ ছাড়া বিভিন্ন ক্যাম্প সংলগ্ন জায়গা থেকে ঝড়ে আহত ১৭টি হরিণ উদ্ধার করার পর চিকিৎসা সেবা করে সুন্দরবনে ছেড়ে দেয়া হয়েছে।
২৪৫ কোটি ৯৫ লাখ টাকার ক্ষতি: ঘূর্ণিঝড় রেমালের তাণ্ডবে জলোচ্ছ্বাস এবং জোয়ারের পানিতে বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয়েছে লোকালয়। সেইসঙ্গে ভেসে গেছে ৩ হাজার ৬০০ পুকুর এবং ৯ হাজার ১১৫টি ঘেরের মাছ, চিংড়ি, কাঁকড়া, পোনা। এতে ক্ষতি হয়েছে ২৪৫ কোটি ৯৫ লাখ ৫০ হাজার টাকার মৎস্য সম্পদের।
জেলা মৎস্য অফিস সূত্রে জানা যায়, ঘূর্ণিঝড় রেমালের আঘাতে খুলনার ৯টি উপজেলার কয়রা, পাইকগাছা, দাকোপ, বটিয়াঘাটা, ডুমুরিয়া ও রূপসা এই ছয়টি উপজেলার ৩৮টি ইউনিয়নের মৎস্য সম্পদের ক্ষতি হয়েছে। এরমধ্যে কয়রা, পাইকগাছা ও দাকোপে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ঝড়ের তাণ্ডবে জেলায় ওই ছয়টি উপজেলার ৩৫৫ দশমিক ৩০ হেক্টর জমির ৩ হাজার ৬০০টি পুকুর এবং ১০ হাজার ২২৩ দশমিক ৭৫ হেক্টর জমির ৯ হাজার ১১৫টি ঘের ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেইসঙ্গে ১ হাজার ৫৯০ হেক্টর জমির ১ হাজার ৩৫৬টি কাঁকড়া, কুচিয়া খামার ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
এবারের ঝড়ে মোট ক্ষতি হয়েছে ২৪৫ কোটি ৯৫ লাখ ৫০ হাজার টাকার মৎস্য সম্পদ। যারমধ্যে ৬৬ কোটি ২৫ লাখ টাকা মূল্যের ৩ হাজার ৭৮ টন মাছ, ১১৪ কোটি ৬৮ লাখ ৭৫ হাজার টাকা মূল্যের ২ হাজার ৫৬৪ টন চিংড়ি, ২০ কোটি ৫৭ হাজার টাকা মূল্যের ৬৩৬ টন পোনা, ১৮ কোটি ৬৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকা মূল্যের ১০২ দশমিক ২০ টন কাঁকড়া ও কুচিয়া, ৯ কোটি ৫০ লাখ টাকা মূল্যের ২৭০ টন পিএল, ২০ লাখ টাকা মূল্যের ২০টি নৌকা-ট্রলার-জলযান এবং ১৬ কোটি ১১ লাখ টাকার অবকাঠামোর ক্ষতি হয়েছে।
খুলনা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা জয়দেব পাল বলেন, ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে খুলনায় মৎস্যচাষিদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। প্রাথমিকভাবে ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করেছি। এতে ২৪৫ কোটি ৯৫ লাখ ৫০ হাজার টাকার সাদা মাছ, চিংড়ি, পোনা, কাঁকড়া ও অবকাঠামোগত ক্ষতি হয়েছে।

বিনা অনুমতিতে এই সাইটের সংবাদ, আলোকচিত্র অডিও ও ভিডিও ব্যবহার করা বেআইনি।